“মানুষেরা উৎসব করে। কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ ।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা:-
ঋতুর বর্ণময় আত্মপ্রকাশের রঙ্গমঞ্চে বাঙালীর মানসিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে ‘বারোমাসে তেরো পার্বণ’এর সম্পর্ক। একঘেয়ে কর্মক্লান্ত জীবনযাত্রায় উৎসব নিয়ে আসে আনন্দঘন বৈচিত্র্য। উৎসবে আমাদের প্রাত্যহিকতার পৌনঃপুনিকতা কাটে। উৎসব বৈচত্র্যহীন জীবনে আনে আনন্দ উচ্ছলতা, পরিপূর্ণ প্রশান্তি সঞ্জীবিত করে দেহ মন। বিরল – সংখ্যক বলেই তো উৎসব এত মধুর । উৎসবের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী বটে, তবু তার প্রভাব আর প্রশান্তি প্রগাঢ়। উৎসব মিলন, শান্তি ও মৈত্রীর ত্রিবেণী বন্ধন।
উৎস:-
উৎসব’ হল বৈদিক ঋষিদের ‘সোমরস’ নিষ্কাশনের এক আনন্দ উদ্বেল লোকাচার। ঋগ্বেদের সমন শব্দ উৎসব বাচক। কালক্রমে উৎসব শব্দের অর্থ বদলে গেছে। এখন উৎসব বলতে আমরা শাস্ত্রীয় ও লৌকিক উভয় অনুষ্ঠানকে বুঝে থাকি। সামগ্রিকভাবে বিচার করলে উৎসব দুভাগে বিভক্ত — চিরায়ত ও লোকায়ত। নাচ, গান, ইন্দ্রজাল, অন্তরীক্ষ, আকাশ, সূর্য, গ্রহ – তারা, পশু – পাখি, গাছপালা, পাহাড়, নদী, দৈবশক্তি, তন্ত্রমন্ত্র, পুরোহিত ইত্যাদির সামগ্রিক যোগফলই উৎসবের উদ্ভব ভূতপ্রেত, ও বিকাশ।
বৈশিষ্ট্য:-
উৎসব কেবলমাত্র লোকাচারের মধ্যেই সীমিত নয়। তিথি, মহাপুরুষের জন্ম ও মৃত্যু, রাষ্ট্রের জন্মদিন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিপ্লব ইত্যাদিকে অবলম্বন করেও আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের উদ্ভব হয়েছে।
বাংলা নববর্ষের দিন বর্ষবোধন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার উৎসবের সূচনা। এরপর পর্যায়ক্রমে আসে রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, বিশ্বকর্মা পূজা, দুর্গোৎসব, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, রাসযাত্রা, পৌষপার্বণ, সরস্বতী পূজা, দোল, বাসন্তীপূজা, শিবরাত্রি ইত্যাদি। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়কপূজা বা গাজন দিয়ে বাংলার ধর্মীয় উৎসবের ঘটে পরিসমাপ্তি। এই সব ধর্মীয় উৎসবের প্রতিটিরই একটা সামাজিক দিকও আছে। উৎসবকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আবার সামাজিক উৎসব অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মের আবরণে অত্মিপ্রকাশ করে, যেমন- অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ, জন্মদিন পালন ইত্যাদি নানা পারিবারিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম হল রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী বা অপরাপর মনীষীদের জন্ম ও মৃত্যুতিথি উদ্যাপন প্রভৃতি। আজকাল বিভিন্ন সভা, সমিতি, সংগঠনের যে বার্ষিক উৎসব গালিত হয় সে সমস্তও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর্যায়েই পড়ে। আর হল স্বাধীনতা দিবস , শহীদ দিবস, নেতাজী জন্ম দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস প্রভৃতি জাতীয় উৎসব।
নানা দেশের সঙ্গে আমরা মে দিবস, রাষ্ট্রসংঘ দিবস বিশ্ব শিশুবর্ষ, আন্তর্জাতিক মৈত্রী দিবস, বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস ইত্যাদি কতকগুলি আন্তর্জাতিক উৎসব পালন করি আমাদের ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। বিরাটভাবে সংখ্যাপ্রধান হিন্দুরা ছাড়াও অন্যান্য বহু সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে তাঁদের নিজ নিজ উৎসবগুলি সাড়ম্বরে পালন করেন। মুসলমান ভাইদের ঈদ, মহরম, ফতেহাদোয়াজ দাহাম, খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন, গুডফ্রাইডে, বৌদ্ধদের বুদ্ধ – পূর্ণিমা, জৈনদের মহাবীর – জয়ন্তী, শিখেদের গুরু নানকের জন্মদিবস প্রভৃতি উৎসব পারস্পরিক সৌহার্দ্যে ও উৎসাহী উপস্থিতিতে মহৎ মিলনোৎসবের রূপ ধারণ করে। জনগোষ্ঠীগুলির ধর্মীয় উৎসব আজকাল সাম্প্রদায়িকতার গণ্ডী ছাড়িয়ে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।
বিবর্তন ও পরিবর্তন:-
একদিন যে উৎসবের সৃষ্টি হয়েছিল ভয়, বিশ্বাস ও সংস্কারকে কেন্দ্র করে, কালান্তরে মানুষের সেই বিশ্বাসবোধক ধারা যুগের পরিবর্তন। ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে রচনা করেছে নির্মল শান্তি, মৈত্রী ও প্রীতির উৎসব। দোল, দুর্গোৎসব, নবান্ন প্রভৃতির আচারগত পরিবর্তন ঘটে গেছে।
উৎসবের প্রয়োজনীয়তা:-
উৎসব বহু মানুষের সম্প্রীতি – স্নিগ্ধ মিলনের ক্ষেত্র প্রশস্ত করে। উৎসবের অঙ্গনে এসে ধরা দেয় বহু মানুষ, — এখানেই তো উৎসবের পরম সার্থকতা। উৎসবের বিপুল আনন্দে আমাদের ক্রিয়াকর্ম বৃহৎ যজ্ঞে পরিণত হয়। আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক উৎসব অনুষ্ঠানগুলি এভাবেই সকলের শুভ কামনায়, সকলের প্রীতিতে সার্থক হয়ে ওঠে। উৎসব বহু মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে ভালোবাসার সেতুবন্ধন, জাতীয় ঐক্যের মূল সুরটি এর মধ্যেই নিহিত। বাঙালীর কবিসত্ত্বা তাই উৎসবের আলোয় খুঁজে পেয়েছে আত্মিক মুক্তির দিশা। আমাদের ঘিরে অভাব – অনটন আছে, ব্যাঘাত আছে, আছে দিন – যাপনের প্রাণ – ধারণের তুচ্ছতা ক্ষুদ্রতার চরম গ্লানি। এ সব থেকে সাময়িক মুক্তিলাভের জন্যই উৎসবের প্রয়োজন। দৈনন্দিনতার খণ্ডিত অস্তিত্বে আনে তা পূর্ণের স্পর্শ, জীবনায়নে আনে বেগ, ভাবনায় আনে আবেগ।
উৎসবের শ্রেণীবিভাগ:-
উৎসবগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
(১) বৈদিক উৎসব: নামকরণ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি।
(২) পৌরাণিক উৎসব: সরস্বতী পূজা, জন্মাষ্টমী, রথযাত্রা, দোলযাত্রা, রাসযাত্রা, ঝুলন, কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা, শিবরাত্রি, দুর্গাপূজা, দেওয়ালি, বুদ্ধ পূর্ণিমা, ঈদ, মহরম, খ্রীষ্টমাস প্রভৃতি।
(৩) লোক উৎসব: চড়ক, গাজন, বনবিবি, দক্ষিণ রায়, পীর ও গাজীর উৎসব, বিশ্বকর্মা, গন্ধেশ্বরী, গোরক্ষনাথ, পৌষ পার্বণ প্রভৃতি।
(৪) সামাজিক উৎসব: ভাই ফোঁটা, বিবাহ, জামাইষষ্ঠী, বিজয়া, নববর্ষ, হালখাতা।
(৫) জাতীয় উৎসব: স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, রবীন্দ্র জয়ন্তী, গান্ধী জয়ন্তী, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ জয়ন্তী, নেতাজী জন্মদিন, মে দিবস প্রভৃতি।
(৬) দুর্গোৎসব: বাঙালীর সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা আজ বাঙালীর জাতীয় উৎসবে পরিণত। বোধন থেকে বিসর্জন এক অনন্যরূপে বাঙালীর জীবনকে আন্দোলিত করে। বিজয়া দশমী বিদায়ের দিন। তবুও এই বিদায় চিরন্তন নয়। বাঙালী দেবীকে বিদায় জানাতে গিয়ে বলেন –আবার এসো মা ফিরে।
(৭) বিবিধ উৎসব: বাঙালী খ্রীষ্টমাসে যেমন মাতোয়ারা হয়, তেমন ঈদ, মহরম, বুদ্ধ পূর্ণিমায়ও সমান উৎফুল্ল হয়। মুসলমান, খ্রীষ্টান, জৈন, বৌদ্ধ প্রত্যেকের উৎসবের সঙ্গে হিন্দুদের উদার মানস সান্নিধ্য যেমন আছে তেমন অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও হিন্দুর উৎসবে অংশগ্রহণ করেন।
উপসংহার:-
এক সময় ছিল, যখন বাংলার উৎসবগুলিতে ছিল ভাবের প্রাধান্য, আন্তরিকতা। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বহিরঙ্গের আড়ম্বর এত প্রাধান্য পেয়েছে যে উৎসবের মূল সংস্কৃতি – মনস্কতা, অন্তরঙ্গ মৌল চরিত্রই বিনষ্ট হতে এ অবস্থার অবসান চাই, উৎসবের মন্ত্রে প্রথম চাই অন্তরের প্রতিষ্ঠা। একথা বাঙালীকে মরণে রাখতে হবে, – বাংলার উৎসবে ভাবের প্রাধান্য, আন্তরিকতাহীন বাইরের সমারোহ তার প্রধান অঙ্গ নয়।
সমাজ সচল, জীবন চলিষ্ণু কালের রূপাত্তরে একদিন উৎসবেরও রূপান্তর ঘটবে। যে গ্রামবাংলার সচ্ছল অর্থনৈতিক পটভূমিতে একদিন অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে উৎসব বিকশিত হয়েছিল, আজ তেমন সচ্ছলতা নেই। আমরা আশা করি আগামী দিনের বাঙালী তার উৎসব – পার্বণকে যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে যথার্থ মূল্য দিয়ে পালন করবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
প্রশ্ন ১. বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান এবং জনপ্রিয় উৎসব কী ?
উত্তর – বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব হল দুর্গাপূজা । পশ্চিমবঙ্গে পালিত সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসব হল দুর্গাপূজা, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দুর্গাৎসব পালন করে থাকে ।
প্রশ্ন ২. পশ্চিমবঙ্গে কয়টি উৎসব আছে ?
উত্তর – পশ্চিমবঙ্গবাসীরা যেমন বলেছিল, “বারো মাস ই তেরো পার্বন” যার অর্থ বারো মাসে তেরোটি উৎসব, পশ্চিমবঙ্গের জীবন সারা বছর ধরে উৎসাহ এবং আনন্দে পূর্ণ। যদিও তালিকাটি তেরোটি উৎসবের চেয়ে বড়ো, পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা উদযাপন করার জন্য কয়েকটি অন্যতম উৎসব বেছে নিয়েছে।
প্রশ্ন ৩.পশ্চিমবঙ্গে কোন মিষ্টি জনপ্রিয় ?
উত্তর – মিষ্টি দই বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু রসগুল্লা ও রাজভোগ ।
প্রশ্ন ৪. বাঙালি সংস্কৃতিতে কী বিখ্যাত ?
উত্তর – বাউল ঐতিহ্য বাংলা লোকসংগীতের একটি অনন্য ঐতিহ্য যা বাঙালি সংস্কৃতিতে এক রূপ এনে দেয় । অন্যান্য লোকসঙ্গীতের মধ্যে রয়েছে যেমন – কবিগান, গোম্ভীরা, ভাওয়াইয়া, কীর্তন এবং গাজন উৎসবের সঙ্গীত।
প্রশ্ন ৫. পশ্চিমবঙ্গের প্রধান খাদ্য কি ?
উত্তর – মাছ এবং ভাত বাঙ্গালির প্রধান ও প্রিয় খাবার । বাঙালিরা এই দুটি খাবারের সাথে একটি যেন অসীম সম্পর্ক রয়েছে যা প্রায় প্রতিটি ঘরেই একটি প্রধান খাবার।
প্রশ্ন ৬. বাংলার বা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক কি ?
উত্তর – শাড়ি হল পশ্চিমবঙ্গের মহিলাদের জন্য ঐতিহ্যবাহী পোশাক। বাঙালি মহিলারা সাধারণত শাড়ি পরেন, প্রায়শই স্থানীয় সাংস্কৃতিক রীতি অনুযায়ী স্বতন্ত্রভাবে ডিজাইন করা হয়। পুরুষরাও ঐতিহ্যবাহী পোশাক যেমন ধুতি বা লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবি বা গেঞ্জি পরেন।
প্রশ্ন ৭.পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি কি ?
উত্তর – পশ্চিমবঙ্গ আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের নিখুঁত মিশ্রণ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। হুগলির নদীর পবিত্রতা, চাষের মাঠ, সবুজ গাছপালা, পূজা-পার্বণ এর আনন্দ, পূর্ব হিমালয়ের সৌন্দর্য, সুন্দরবনের বৈচিত্র্য এবং চা বাগানের সতেজতা, সবকিছু মিলে মিশে আমরা যাকে পশ্চিমবঙ্গের অনন্য সংস্কৃতি বলি।